ভারতে ২০২৫ সালের ৮ এপ্রিল থেকে কার্যকর হওয়া নতুন ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক এবং প্রতিবাদ চলছে। এই আইন ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও দাতব্য সম্পত্তি পরিচালনার নিয়মে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এই আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, সহিংসতা এবং আইনি লড়াই শুরু হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশেও এই আইন নিয়ে প্রতিবাদের ঘটনা ঘটেছে। নতুন ওয়াকফ আইনের বিস্তারিত বিশ্লেষণ, এর প্রধান বৈশিষ্ট্য এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কারণগুলো তুলে ধরব।
ওয়াকফ কী? ওয়াকফ হলো ইসলাম ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রথা, যেখানে কোনো ব্যক্তি তার স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি ধর্মীয়, শিক্ষাগত বা জনহিতকর কাজের জন্য দান করে। এই সম্পত্তি বিক্রি বা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যায় না, কারণ এটি আল্লাহর সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। ভারতে ওয়াকফ বোর্ডের অধীনে প্রায় ৮.৭ লক্ষ সম্পত্তি রয়েছে, যা ৯.৪ লক্ষ একর জমি জুড়ে বিস্তৃত এবং এর মোট মূল্য প্রায় ১.২ লক্ষ কোটি টাকা। এটি ভারতীয় রেলওয়ে এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীর পর তৃতীয় বৃহত্তম সম্পত্তির মালিক।
নতুন ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন ২০২৫: প্রধান বৈশিষ্ট্য ওয়াকফ (সংশোধনী) বিলটি ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট ভারতীয় লোকসভায় পেশ করা হয় এবং ২০২৫ সালের এপ্রিলে পার্লামেন্টে পাস হয়। ৫ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু এতে সম্মতি দেন, এবং ৮ এপ্রিল থেকে এটি আইনে পরিণত হয়। এই আইন ১৯২৩ সালের মুসলমান ওয়াকফ আইন বাতিল করে এবং ১৯৯৫ সালের ওয়াকফ আইন সংশোধন করে। এটির নাম পরিবর্তন করে ‘একীভূত ওয়াকফ ব্যবস্থাপনা, ক্ষমতায়ন, দক্ষতা এবং উন্নয়ন আইন, ১৯৯৫’ (UWMEED Act) করা হয়েছে। নিচে এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ করা হলো:
কেন্দ্রীভূত নিবন্ধন ও পর্যবেক্ষণ:
ওয়াকফ সম্পত্তির জন্য কেন্দ্রীয় ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।
রিয়েল-টাইম সরকারি পর্যবেক্ষণ এবং জালিয়াতি প্রতিরোধের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
জেলাশাসকের ভূমিকা বৃদ্ধি:
ওয়াকফ সম্পত্তি সংক্রান্ত বিরোধে জেলাশাসকদের তদন্ত ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
এর আগে এই ক্ষমতা ছিল শুধু ওয়াকফ বোর্ডের হাতে।
‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ ধারা বাতিল:
পূর্বে, দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় বা জনহিতকর কাজে ব্যবহৃত কোনো সম্পত্তি নথি ছাড়াই ওয়াকফ হিসেবে গণ্য হতো। নতুন আইনে এই ধারা বাতিল করা হয়েছে, যার ফলে প্রাচীন মসজিদ, দরগাহ বা কবরস্থানের মতো সম্পত্তির স্বীকৃতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
অমুসলিম সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি:
কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিল এবং রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্যদের রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব:
কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিল এবং রাজ্য বোর্ডে কমপক্ষে দুজন মুসলিম নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে।
নারীদের উত্তরাধিকার অধিকার এবং সম্পত্তিতে ন্যায্য প্রবেশাধিকারের জন্য আইনি সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে।
ট্রাইবুনালের আদেশে আপিল:
পূর্বে ওয়াকফ ট্রাইবুনালের সিদ্ধান্ত ছিল চূড়ান্ত, এবং এর বিরুদ্ধে আপিল করা যেত না। নতুন আইনে ট্রাইবুনালের আদেশ ৯০ দিনের মধ্যে উচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা:
ওয়াকফ সম্পত্তির নিবন্ধন, অডিট এবং হিসাব ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে নিয়ম তৈরির ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
এটি দুর্নীতি এবং অবৈধ জমি দখলের অভিযোগের প্রেক্ষাপটে করা হয়েছে।
নতুন আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কারণ
নতুন ওয়াকফ আইন ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, সহিংসতা এবং সুপ্রিম কোর্টে ৭৩টিরও বেশি পিটিশন দায়ের করা হয়েছে। প্রতিবাদের প্রধান কারণগুলো নিচে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো:
ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ:
আইনটি ভারতীয় সংবিধানের ২৬ নম্বর ধারা লঙ্ঘন করে, যা ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত করে। অমুসলিম সদস্যদের ওয়াকফ বোর্ডে অন্তর্ভুক্তি এবং জেলাশাসকদের ক্ষমতা বৃদ্ধি মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সরকারি হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বিভিন্ন সংগঠন দাবি করেছে যে, এটি ওয়াকফের ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যকে নষ্ট করবে।
‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ ধারা বাতিল:
এই ধারা বাতিলের ফলে বহু প্রাচীন মসজিদ, দরগাহ এবং কবরস্থানের ওয়াকফ মর্যাদা হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। এই সম্পত্তিগুলোর মালিকানা প্রমাণের জন্য নথি দাখিল করতে হবে, যা ৪০০-৫০০ বছরের পুরোনো সম্পত্তির ক্ষেত্রে প্রায় অসম্ভব।
আইনজীবী কপিল সিব্বল সুপ্রিম কোর্টে দাবি করেছেন যে, এই ধারা ইসলাম ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের আশঙ্কা:
উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে বিতর্কিত ওয়াকফ সম্পত্তি চিহ্নিত করে বাজেয়াপ্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।
আসাদউদ্দিন ওয়াইসি অভিযোগ করেছেন যে, এই আইনের মাধ্যমে মসজিদ এবং দরগাহের মতো সম্পত্তি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের দাবি অনুযায়ী কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।
সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা:
পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ এবং ভাঙড়ে ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। মুর্শিদাবাদে তিনজনের মৃত্যু এবং শতাধিক মানুষ গৃহহীন হয়েছেন।
এই ঘটনাগুলো হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে, যা অনেকে কেন্দ্রীয় সরকারের মুসলিম-বিরোধী নীতির ফল হিসেবে দেখছেন।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্য:
বিরোধী দলগুলো, যেমন কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি এবং ডিএমকে, দাবি করেছে যে, এই আইন হিন্দু ভোটারদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ভাবাবেগ জাগিয়ে তুলতে এবং আসন্ন নির্বাচনে রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের জন্য পাস করা হয়েছে।
তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, এটি মুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ।
অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর প্রভাব:
কিছু মুসলিম নেতা, যেমন মৌলানা আবদুল্লা, আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, এই আইন ভবিষ্যতে খ্রিস্টান এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্পত্তির উপরও প্রভাব ফেলতে পারে।
প্রতিবাদের চিত্র
ভারতে প্রতিবাদ:
পশ্চিমবঙ্গ: মুর্শিদাবাদে ১১-১২ এপ্রিল সহিংস প্রতিবাদে তিনজন নিহত এবং বহু মানুষ গৃহহীন হয়েছেন। ভাঙড়ে ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ) কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে পুলিশের মোটরবাইক এবং বাসে আগুন দেওয়া হয়।
কেরালা: সলিডারিটি ইয়ুথ মুভমেন্ট এবং স্টুডেন্টস ইসলামিক অর্গানাইজেশনের বিক্ষোভে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে।
হায়দ্রাবাদ: অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড এবং এআইএমআইএম-এর নেতৃত্বে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন।
আইনি লড়াই:
সুপ্রিম কোর্টে ৭৩টি পিটিশন দায়ের করা হয়েছে। আসাদউদ্দিন ওয়াইসি, মহুয়া মৈত্র এবং অন্যান্য রাজনীতিক এই আইনকে ‘অসাংবিধানিক’ বলে চ্যালেঞ্জ করেছেন।
১৬ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টে শুনানিতে প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্না কেন্দ্রীয় সরকারকে ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ ধারা বাতিলের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলেছেন। কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিজেপি নেতারা দাবি করেছেন যে, এই আইন ওয়াকফ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, এটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উপকারে আসবে। তবে বিরোধীরা এটিকে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।

নতুন ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন ২০২৫ ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা এবং প্রতিবাদের সৃষ্টি করেছে। যদিও সরকার এটিকে স্বচ্ছতা ও আধুনিকীকরণের পদক্ষেপ হিসেবে উপস্থাপন করছে, সমালোচকরা এটিকে ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের হাতিয়ার হিসেবে দেখছেন। পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা এবং উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে সহিংসতা এবং বাংলাদেশে প্রতিবাদ এই ইস্যুটির সংবেদনশীলতা প্রকাশ করে। সুপ্রিম কোর্টের চলমান শুনানি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া এই আইনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

Facebook Comments Box
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply