ইন্ডিয়া হেট ল্যাব (আইএইচএল)-এর ২০২৪ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তৃতার ঘটনা ২০২৩ সালের তুলনায় ৭৪.৪% বৃদ্ধি পেয়ে ১,১৬৫টিতে পৌঁছেছে। এই ঘটনাগুলি রাজনৈতিক সমাবেশ, ধর্মীয় মিছিল, প্রতিবাদ মিছিল এবং সাংস্কৃতিক সমাবেশে ঘটেছে, যার মধ্যে ৯৮.৫% মুসলিমদের লক্ষ্য করে এবং ১০% খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে ছিল। ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচন এবং মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খণ্ডের রাজ্য নির্বাচন এই বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ। সামাজিক মাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুক (৪৯৫টি ভিডিও) এবং ইউটিউব (২১১টি ভিডিও), বিদ্বেষমূলক বক্তৃতা ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ২৫৯টি বিপজ্জনক বক্তৃতার মধ্যে ২১৯টি সামাজিক মাধ্যমে লাইভ-স্ট্রিম করা হয়েছে, যার মধ্যে মাত্র ৩টি ফেসবুক থেকে সরানো হয়েছে। বিজেপি নেতারা, যার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ এবং যোগী আদিত্যনাথ উল্লেখযোগ্যভাবে জড়িত ছিলেন, ৩৪০টি ঘটনার আয়োজন করেছেন। উত্তর প্রদেশ (২৪২টি ঘটনা), মহারাষ্ট্র (২১০টি ঘটনা) এবং মধ্য প্রদেশে সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে। ১১৮টি ঘটনা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এবং ১৮২টি “বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী” নিয়ে মিথ্যা আখ্যান ছড়িয়েছে। ২৭৪টি বক্তৃতায় মুসলিম ও খ্রিস্টানদের উপাসনালয় ধ্বংসের আহ্বান জানানো হয়েছে, এবং ১২৩টি বক্তৃতায় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ব্যবহারের প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে।


ইন্ডিয়া হেট ল্যাব (আইএইচএল), ওয়াশিংটন-ভিত্তিক সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ অর্গানাইজড হেট (সিএসওএইচ)-এর একটি প্রকল্প, ২০২৪ সালে ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তৃতার ঘটনাগুলির উপর একটি বিস্তৃত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনটি রাজনৈতিক সমাবেশ, নির্বাচনী প্রচার, ধর্মীয় মিছিল, প্রতিবাদ মিছিল এবং সাংস্কৃতিক বা জাতীয়তাবাদী সমাবেশে ঘটে যাওয়া ১,১৬৫টি যাচাইকৃত বিদ্বেষমূলক বক্তৃতার ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ৬৬৮, যা ২০২৪ সালে ৭৪.৪% বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৃদ্ধি ভারতের ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচন, মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খণ্ডের রাজ্য নির্বাচন এবং বাংলাদেশে হিন্দুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার অতিরঞ্জিত দাবির কারণে ত্বরান্বিত হয়েছে।

প্রধান ফলাফল

  • লক্ষ্যবস্তু: ১,১৬৫টি ঘটনার মধ্যে ৯৮.৫% মুসলিমদের লক্ষ্য করে এবং প্রায় ১০% খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে ছিল। ১১৮টি ঘটনা (১০.১%) রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এবং ১৮২টি (১৫.৬%) “বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী” নিয়ে মিথ্যা আখ্যান ছড়িয়েছে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তৃতা ২০২৩ সালের তুলনায় ২১০% বৃদ্ধি পেয়েছে।
  • নির্বাচনের ভূমিকা: ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচন (১৯ এপ্রিল থেকে ১ জুন) এবং মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খণ্ডের রাজ্য নির্বাচনের সময় বিদ্বেষমূলক বক্তৃতা বৃডি় পায়। মে মাসে ২৬৯টি ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে, যা সর্বোচ্চ। উত্তর প্রদেশ (২৪২টি), মহারাষ্ট্র (২১০টি) এবং মধ্য প্রদেশে সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে।
  • বিজেপির ভূমিকা: বিজেপি ৩৪০টি ঘটনার আয়োজন করেছে, যা ২০২৩ সালের তুলনায় ৫৮০% বৃদ্ধি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ (৫৮টি বক্তৃতা), এবং উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ (৮৬টি বক্তৃতা) উল্লেখযোগ্যভাবে জড়িত ছিলেন। মোদীর ২১ এপ্রিল রাজস্থানের বাঁসওয়ারায় দেওয়া একটি বক্তৃতায় মুসলিমদের “অনুপ্রবেশকারী” হিসেবে উল্লেখ করা হয়, যা বিদ্বেষমূলক বক্তৃতার ঢেউ তুলেছিল।
  • বিপজ্জনক বক্তৃতা: ২৫৯টি বিপজ্জনক বক্তৃতার মধ্যে ২১৯টি সামাজিক মাধ্যমে লাইভ-স্ট্রিম করা হয়েছে। ১২৩টি বক্তৃতায় (১০.৬%) হিন্দুদের সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে “সুরক্ষার” জন্য অস্ত্র সংগ্রহের আহ্বান জানানো হয়েছে, যা ২০২৩ সালের তুলনায় ৩২.৩% বৃদ্ধি পেয়েছে। ১১১টি বক্তৃতায় (৯.৫%) মুসলিমদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বয়কটের আহ্বান জানানো হয়েছে।
  • উপাসনালয়ের বিরুদ্ধে আক্রমণ: ২৭৪টি বক্তৃতা (২৩.৫%) মুসলিম ও খ্রিস্টানদের উপাসনালয় দখল, অপসারণ বা ধ্বংসের আহ্বান জানিয়েছে, যা ২০২৩ সালের তুলনায় ৬২.১% বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজেপি নেতারা এর মধ্যে ৮৪টি বক্তৃতার জন্য দায়ী।
  • সামাজিক মাধ্যমের ভূমিকা: ১,১৬৫টি ঘটনার মধ্যে ৯৯৫টি সামাজিক মাধ্যমে প্রথম শেয়ার বা লাইভ-স্ট্রিম করা হয়েছে। ফেসবুক ৪৯৫টি ঘটনার জন্য শীর্ষ প্ল্যাটফর্ম, তারপরে ইউটিউব (২১১টি), ইনস্টাগ্রাম এবং এক্স। ২৬৬টি বিজেপি নেতাদের বক্তৃতা একাধিক প্ল্যাটফর্মে লাইভ-স্ট্রিম করা হয়েছে। ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ পর্যন্ত, ফেসবুক মাত্র ৩টি ভিডিও সরিয়েছে, ৯৮.৪% ভিডিও এখনও প্ল্যাটফর্মে রয়ে গেছে।

প্রধান প্রবণতা

বিদ্বেষমূলক বক্তৃতার ধরণে হিন্দু জাতীয়তাবাদী আখ্যান প্রাধান্য পেয়েছে, যেখানে মুসলিম ও খ্রিস্টানদের “বহিরাগত” হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। মুসলিমদের “অনুপ্রবেশকারী” হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, বিশেষ করে বাংলাদেশী অভিবাসী বা রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে। হিন্দু কট্টরপন্থী নেতারা মুসলিমদের পরজীবী এবং চোর হিসেবে চিত্রিত করেছেন, যারা হিন্দুদের সম্পদ হরণ করছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এই বক্তৃতাগুলি সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বৈষম্য ও শত্রুতা বাড়িয়েছে।

বিজেপি-শাসিত রাজ্য

প্রায় ৮০% ঘটনা (৯৩১টি) বিজেপি-শাসিত রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ঘটেছে। উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র এবং মধ্য প্রদেশে প্রায় অর্ধেক ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। উত্তর প্রদেশে ২৪২টি ঘটনা ২০২৩ সালের তুলনায় ১৩২.৭% বৃদ্ধি পেয়েছে। মহারাষ্ট্রে ২১০টি ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৯৫টি সরাসরি মুসলিম-বিরোধী ছিল।

পদ্ধতি

প্রতিবেদনটি জাতিসংঘের বিদ্বেষমূলক বক্তৃতার কাঠামো এবং রাবাত প্ল্যান অফ অ্যাকশনের ছয়-অংশের পরীক্ষার উপর ভিত্তি করে তৈরি। এটি সামাজিক মাধ্যম ট্র্যাকিং, মিডিয়া বিশ্লেষণ, ফিল্ড রিপোর্টিং এবং যাচাইকরণের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করেছে।

উপসংহার

২০২৪ সালে ভারতে বিদ্বেষমূলক বক্তৃতার উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে মুসলিম ও খ্রিস্টানদের প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতার ঝুঁকি বাড়িয়েছে। বিজেপি এবং এর মিত্রদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সামাজিক মাধ্যমের ভূমিকা এই সমস্যাকে আরও জটিল করেছে। সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলি তাদের নীতি সত্ত্বেও বিদ্বেষমূলক কন্টেন্ট নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে, যা হিন্দু জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের প্রসারে সহায়তা করেছে।

উৎস: ইন্ডিয়া হেট ল্যাব, “রিপোর্ট ২০২৪: হেট স্পিচ ইভেন্টস ইন ইন্ডিয়া,” ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫। মূল প্রতিবেদনটি পড়ুন এখানে ক্লিক করে।

Facebook Comments Box
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply