ভারতীয় সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ গত ৮ মে নয়াদিল্লি থেকে আটক ৪৩ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মিয়ানমার সামুদ্রিক সীমান্তের কাছাকাছি আন্তর্জাতিক জলে ফেলে দিয়েছে। ওই অভিযানে শিশু, নারী ও বৃদ্ধদের জোর করে জলে নামতে বাধ্য করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও তাদের লাইফ জ্যাকেট দেওয়া হয়েছিল, সাঁতরে তীরে পৌঁছাতে হয় তাদের।
অবাক করার বিষয়, এই ঘটনার দিনেই ভারতের সলিসিটর জেনারেল সুপ্রিম কোর্টে জানান, রোহিঙ্গাদের যেকোনো প্রত্যাবাসন “আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই” হবে।
নয়াদিল্লিতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিরুদ্ধে চলমান দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত একাধিক আবেদনের শুনানিতে, সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, যাদের ‘বিদেশি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদের প্রত্যাবাসন করতে হবে।
রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সরকারের কাছে রাষ্ট্রহীন হিসেবে বিবেচিত হয় এবং তাদের ফেরত নিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়েছে। গণহত্যার কারণে তারা দেশ ছেড়ে পালিয়েছিল।
মাকতুব-কে দুইজন রোহিঙ্গা শরণার্থী জানিয়েছেন, দিল্লির উত্তম নগর থেকে আটক তাদের আত্মীয়রা মিয়ানমারে পৌঁছেছেন। ভারতের সুপ্রিম কোর্টে জমা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত এক আবেদনে বলা হয়েছে, “যাদের ফেলে দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে ১৫ বছর বয়সী শিশু, ১৬ বছরের নারী কিশোরী, ৬৬ বছর বয়সী বৃদ্ধ এবং ক্যান্সারসহ নানা রোগে আক্রান্ত মানুষ রয়েছেন।”
রোহিঙ্গা খ্রিস্টান প্রতিনিধি ডেভিড নাজির জানান, তার বাবা-মাকে দিল্লি থেকে আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরে নৌবাহিনীর জাহাজে হাত বাঁধা ও চোখ বেঁধে তোলা হয়।
দিল্লি পুলিশের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহের জন্য তাদের আটক করা হয়েছে। অথচ ১৩ জন নারীসহ এই ৪৩ জন রোহিঙ্গা জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা (UNHCR) ভারতের রেজিস্টার্ড সদস্য।
সুপ্রিম কোর্টে জমা দেওয়ার জন্য তৈরি আবেদনে আরও বলা হয়েছে, এক নারী বন্দি তার আত্মীয়কে জানিয়েছেন যে, জলে ফেলে দেওয়ার আগে কর্মকর্তারা তাদের যৌন নিপীড়ন ও অশ্লীলভাবে স্পর্শ করেছিলেন।
এক ১৬ বছর বয়সী মেয়েকে তার পরিবারের কাছ থেকে আলাদা করে আন্তর্জাতিক জলসীমায় ফেলে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
আটকদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তারা মিয়ানমারে যেতে চান নাকি ইন্দোনেশিয়ায়। সবাই মিয়ানমারে যেতে রাজি হননি, কিন্তু পরে তাদের মিথ্যা আশ্বাসে ফেলে আন্তর্জাতিক জলে ফেলে দেওয়া হয়।
জলে ভেসে এসে তারা বুঝতে পারেন তারা মিয়ানমারে পৌঁছেছেন।
আন্তর্জাতিক বিচার আদালত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চালানো কর্মকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং জানিয়েছে মিয়ানমারে তারা চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
ভারত ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশন স্বাক্ষরকারী না হলেও, জাতিসংঘের “নির্যাতন ও নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ প্রতিরোধ কনভেনশন”-এ স্বাক্ষর করেছে, যার ৩ নম্বর অনুচ্ছেদ বলেছে, কোনো ব্যক্তিকে এমন জায়গায় ফেরত পাঠানো যাবে না যেখানে তার জীবনের ঝুঁকি আছে।
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা স্বীকার করেছেন যে, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে “পুশব্যাক” করা হয়েছে।
শরণার্থী নুর জানান, তিনি ও আরও ২৫ জন শিক্ষার্থী ৬ মে রাত থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তারা সবাই ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ওপেন স্কুলিং-এ পড়ে এবং বাবা-মা ছাড়া উত্তম নগরে থাকত।
৬ ও ৭ মে দিল্লির বিভিন্ন এলাকা থেকে অন্তত ৬৯ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে বলে সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করা আবেদনে বলা হয়েছে।
আটক থাকা অবস্থায় নারী ও শিশুদের ১০ ঘণ্টা ধরে পুলিশ স্টেশনে রাখা হয়, কোনো খাবার দেওয়া হয়নি এবং পরে ইন্দারলোক ডিটেনশন সেন্টারে পাঠানো হয়।
নুর বলেন, “একটা নৌকায় নিয়ে তাদের হাত ও পা বাঁধা হয়, এবং জলে ফেলে দেওয়া হয়। এটা বর্বরতা ছাড়া কিছু নয়।”
আইনজীবী ফজল আবদালি বলেন, “UNHCR দ্বারা স্বীকৃত হওয়া সত্ত্বেও, রোহিঙ্গারা ভারতের আইনে কোনো সুরক্ষা পান না। ‘নন-রিফাউলমেন্ট’ নীতির লঙ্ঘন মানবিকতা সংকোচনের স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়।”
প্রায় ৪০,০০০ রোহিঙ্গা ভারতে আশ্রয় চেয়েছে, UNHCR-এর মতে ১৮,০০০ জন তাদের সাথে নিবন্ধিত।
জাতিসংঘের জাতিগত বৈষম্য নির্মূল কমিটি (CERD) ভারতকে রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে আটক বন্ধ ও মিয়ানমারে জোরপূর্বক প্রত্যাবাসন থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে গণহত্যা চালিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করে, এবং লক্ষাধিক রোহিঙ্গা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। ২০২১ সালে সেই জেনারেলরাই সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে।
মাক্তুব মিডীয়ার জন্য শাহীন আব্দুল্লার লেখা, বাংলাকালের জন্য অনুবাদ করেছেন নিজাম পারভেজ। মূল লেখাটি এখানে ক্লিক করে পড়া যাবে।