গত এক সপ্তাহে গাজার বিভিন্ন এলাকায় ১৪ জন প্রবীণ ফিলিস্তিনির মৃত্যু নথিভুক্ত হয়েছে, যারা ক্ষুধা, অপুষ্টি ও চিকিৎসার অভাবে প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানিয়েছে ইউরো-মেডিটারেনিয়ান হিউম্যান রাইটস মনিটর।
মানবাধিকার সংস্থাটি বলেছে, “এই মৃত্যুগুলি সরাসরি ইসরায়েলের আরোপিত অবরোধের ফল, যা ২ মার্চ থেকে সীমান্ত সম্পূর্ণ বন্ধ করে মানবিক সাহায্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য গাজায় প্রবেশে বাধা দিচ্ছে।”
এই প্রবীণরা মারা গেছেন গাজার বিভিন্ন স্থানে, যেখানে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি এবং ওষুধের চরম সংকট চলছে।
ইউরো-মেড মনিটর জানায়, অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়েছে, স্বাস্থ্যব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে, এবং সবচেয়ে মৌলিক চিকিৎসাসেবাও অনুপলব্ধ। ফলে প্রবীণ এবং দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করছেন।
৮৪ বছর বয়সী মুসবাহ আব্দুল রউফ আব্দুল গাফুর শনিবার খান ইউনিসে মারা যান। ইউরো-মেড মনিটরকে তাঁর পরিবার জানায়, তিনি পেটের ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন এবং অবরোধের কারণে গাজার বাইরে চিকিৎসা নিতে পারেননি। ভেতরে কোনো চিকিৎসা না পাওয়ায়, অপুষ্টি ও উপযুক্ত খাবারের অভাবে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে এবং তিনি মারা যান।
৭ মে মঙ্গলবার, ৮০ বছর বয়সী তালিব সাব্বাহ সুলাইমান আল-আরজা-র মৃত্যু রেকর্ড করা হয়। তাঁর ছেলে জালাল ইউরো-মেড মনিটরকে বলেন: “গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এবং কঠোর অবরোধ আরোপের পর আমার বাবার শরীর খারাপ হতে থাকে। আমরা রাফাতে চরম দুরবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলাম। পরে খান ইউনিসে স্থানান্তরিত হলে দুর্দশা আরও বেড়ে যায়। তাঁবুতে প্রচণ্ড গরম, রাতে পোকামাকড়ের কামড়—একজন প্রবীণ মানুষের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব ছিল না। বাবা বারবার ঠান্ডা পানি চাইতেন, কিন্তু দিতে পারতাম না। তিনি মুরগি, মাছ, ডিম, ফল ইত্যাদি খেতে চাইতেন—কিন্তু কিছুই জোটেনি।”
তিনি আরও বলেন, “সম্প্রতি তাঁর শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। ক্ষুধা ও অপুষ্টির কারণে শরীর দুর্বল ও ন্যুব্জ হয়ে পড়ে। আমরা তাঁকে নাসের হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে চিকিৎসকরা জানান তিনি মারাত্মক অ্যানিমিয়া ও প্রোটিন-খনিজের ঘাটতিতে ভুগছেন। প্রায় ৩০ ঘণ্টা চিকিৎসাধীন থাকার পর তাঁর শরীর আর সাড়া দিচ্ছিল না, এবং অবশেষে তিনি মারা যান।”
ইউরো-মেড মনিটর জানিয়েছে, অনেক প্রবীণ রোগী হাসপাতালে আসছেন যাঁরা সবাই গুরুতর অপুষ্টি ও অ্যানিমিয়ায় ভুগছেন। দীর্ঘমেয়াদি রোগের চিকিৎসা না পেয়ে তাঁরা কেবল টিনজাত খাবারের ওপর নির্ভর করছেন, যার ফলে তাঁদের স্বাস্থ্যের চরম অবনতি ঘটছে এবং অনেকে প্রাণ হারাচ্ছেন।
সংস্থাটি আরও জানিয়েছে, চিকিৎসাব্যবস্থার ধ্বংস, খাদ্যের ঘাটতি ও দুর্ভিক্ষের ফলে প্রবীণ, শিশু ও রোগীদের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। ইসরায়েলি অবরোধের ফলে গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থার পদ্ধতিগত ভেঙে পড়াই এর মূল কারণ।
এছাড়াও, গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এ ধরনের মৃত্যুর পর্যবেক্ষণের কোনো কার্যকর ব্যবস্থাও নেই। ফলে এসব মৃত্যু প্রায়শই ‘প্রাকৃতিক মৃত্যু’ হিসেবে নথিভুক্ত হয়, যদিও বাস্তবে এগুলো ইচ্ছাকৃত অভুক্ত রাখার নীতির ফল এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও ফৌজদারি আইনের লঙ্ঘন।
সংস্থাটি বলেছে, এই ধরনের কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রোম সংবিধান অনুযায়ী সবচেয়ে গুরুতর অপরাধের মধ্যে পড়ে, বিশেষ করে ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে অনাহারে মারার ঘটনা যা যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়।
তাদের ভাষ্য অনুযায়ী: “এই কর্মকাণ্ডগুলো গণহত্যার আইনি সংজ্ঞার মধ্যেও পড়ে—যেমন হত্যা, গুরুতর শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি, অথবা এমন জীবনযাপনের পরিবেশ আরোপ করা যা একটি সুরক্ষিত জনগোষ্ঠীকে আংশিক বা সম্পূর্ণ ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। গত ১৯ মাস ধরে গাজার বেসামরিক জনগণের ওপর ইসরায়েলের এই ধরনের অপরাধ চলমান রয়েছে।”