অ্যাশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আলি খান মাহমুদাবাদকে ‘অপারেশন সিন্দুর’ নিয়ে মন্তব্য করার জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে প্রবল নিন্দার ঝড় উঠেছে। বহু সাংসদ, রাজনৈতিক নেতা, সমালোচক ও মানবাধিকার কর্মীরা একে “শিক্ষাবিদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার রাজনীতি” এবং “মুসলিম পরিচয়ের জন্য নিশানা বানানো” বলে অভিযোগ তুলেছেন।

কংগ্রেস নেতা পবন খেরা মন্তব্য করেন, “তাঁর একমাত্র ভুল — তিনি এই পোস্টটি লিখেছিলেন। আর দ্বিতীয় ভুল — তাঁর নাম।” তিনি বলেন, “একজন ইতিহাসবিদ ও শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সহিংসতা উসকে দেওয়ার জন্য নয়, বরং সহিংসতার বিরোধিতা করার জন্য। তাঁর অপরাধ? ক্ষমতার সামনে সত্য বলা, বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মুখোশ খুলে দেওয়া, আর মেকি দেশপ্রেমের ভণ্ডামি তুলে ধরা।”

খেরা আরও বলেন, “যেখানে বিজেপি মন্ত্রীরা ও উপ-মুখ্যমন্ত্রী সেনাবাহিনীকে অপমান করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন, সেখানে একজন অধ্যাপককে শুধুমাত্র মতপ্রকাশের জন্য জেলে পাঠানো হচ্ছে। এটি শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, বরং গোটা দেশের বাকস্বাধীনতা, মতের ভিন্নতা ও চিন্তাশীলদের কণ্ঠরোধ করার একটা চক্রান্ত।”

তিনি জানান, আলি খান মাহমুদাবাদ হলেন প্রাক্তন বিদেশ সচিব পদ্মভূষণ প্রাপ্ত জগত এস. মেহতার নাতি, যিনি ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত ভারতের বিদেশ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ মহুয়া মৈত্র এই গ্রেপ্তারের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, “এই পোস্টে এমন কিছুই ছিল না যা অপরাধমূলক, বা রাষ্ট্রদ্রোহিতার আওতায় পড়ে। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে শুধুমাত্র তাঁর নামের কারণে।”

তিনি বলেন, “ভোর ৬:৩০ টায় ১৫ জন হরিয়ানার পুলিশ তাঁর বাড়িতে ঢুকে তাঁকে তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর সামনে থেকে ধরে নিয়ে যায়।”

মহুয়া মৈত্র আরও বলেন, “অ্যাশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও কর্তৃপক্ষের নীরবতাও লজ্জাজনক। শুধুমাত্র পয়সা খরচ করলেই উদার শিল্পকলার বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে না — তার জন্য মেরুদণ্ড লাগে।”

অন্যদিকে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও লেখক অপূর্বানন্দ বলেন, “এই গ্রেপ্তারের মাধ্যমে একটাই বার্তা দেওয়া হচ্ছে — মুসলিমরা মত প্রকাশ করতেই পারেন, কিন্তু তার জন্য তাঁদের স্বাধীনতা থাকবে না। এই বার্তা মুসলিমদের বুদ্ধিজীবী শ্রেণিকে ভয় দেখানোর জন্য।”

তিনি এই ঘটনার সঙ্গে প্রাক্তন সাংসদ ও গুজরাট দাঙ্গায় নিহত এহসান জাফরির ঘটনাকে তুলনা করেন।

অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, বিজেপি মন্ত্রী বিজয় শাহ যিনি কর্নেল সোফিয়া কুরেশিকে ‘জঙ্গিদের বোন’ বলে কটাক্ষ করেন, তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, অথচ শান্তিপূর্ণভাবে মতপ্রকাশ করায় মাহমুদাবাদকে জেলে পাঠানো হয়েছে।

ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির মুখপাত্র অনীশ গাওয়ান্ডে বলেন, “আমি সহ ১২০০ জন এইচডব্লিউসি-র নোটিশ প্রত্যাহারের দাবিতে একটি চিঠিতে সই করেছি। আজকের গ্রেপ্তার দেখাচ্ছে সরকার কতটা মরিয়া বাকস্বাধীনতা থামাতে।”

তিনি বলেন, “এটি আইনশৃঙ্খলার বিষয় নয়, বরং শিক্ষাবিদদের চুপ করানোর এবং ক্ষমতাধরদের ঘৃণার ভাষাকে প্রশ্রয় দেওয়ার বিষয়।”

অ্যাশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পরিষদ এক বিবৃতিতে এই গ্রেপ্তারকে “ভিত্তিহীন ও অযৌক্তিক” বলে চিহ্নিত করে তীব্র নিন্দা করেছে। তাঁরা অভিযোগ করেন, মাহমুদাবাদকে বিনা ওষুধে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়িতে ঘুরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কোথায় রাখা হয়েছে সে সম্পর্কে কিছুই জানানো হয়নি।

পরিষদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “তিনি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অমূল্য সদস্য, ছাত্রদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক এবং একজন দায়িত্বশীল নাগরিক, যিনি সর্বদা সম্প্রীতি ও বৃহত্তর কল্যাণের পক্ষে কথা বলেন।”

জার্নালিস্ট রাধিকা বোর্ডিয়া বলেন, “তিনি গীতা, হজরত মুহাম্মদ ও রুমির কথা তুলে শান্তির পক্ষে কথা বলেছেন। অথচ তাঁর এই মননশীল বার্তাগুলোকেও বিদ্রোহ হিসেবে দেখা হচ্ছে, কারণ তিনি একজন মুসলিম।”

ইতিহাসবিদ ও লেখক মুকুল কেশবন বলেন, “যেখানে একজন বিজেপি মন্ত্রী প্রকাশ্যে সেনাবাহিনীর মুসলিম অফিসারকে অপমান করেও রেহাই পান, সেখানে মাহমুদাবাদকে শান্তির বার্তা দেওয়ার জন্য গ্রেপ্তার করা হয় — এটি বাকস্বাধীনতার উপর এক ভয়ঙ্কর আঘাত।”

আলি খান মাহমুদাবাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (BNS)-এর অধীনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট, সশস্ত্র বিদ্রোহ উসকে দেওয়া এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগে মামলা করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ৭ই মে ভারতের ‘অপারেশন সিন্দুর’ নিয়ে মাহমুদাবাদ একাধিক সামাজিক মাধ্যমে শান্তির পক্ষে বার্তা দেন, যার পরিপ্রেক্ষিতেই তাঁকে নিশানা করা হয়।

হরিয়ানা মহিলা কমিশন মাহমুদাবাদের মন্তব্যকে “ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর মহিলা অফিসারদের অবমাননা” এবং “সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো” বলে অভিযোগ তোলে। মাহমুদাবাদ অবশ্য এসব অভিযোগকে “মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়রানি” বলে উড়িয়ে দেন।

এক খোলা চিঠিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ১২০০-এর বেশি বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, আমলারা এই ঘটনার নিন্দা করে হরিয়ানা মহিলা কমিশনের কাছে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানিয়েছেন।


Facebook Comments Box
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply