~নিকিতা জৈন
রাজস্থান পুলিশের সাম্প্রতিক অভিযানে এক মাস বয়সী এক নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনা মেওয়াত অঞ্চলে ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। অভিযোগ উঠছে, সাইবার অপরাধ দমনের নামে পুলিশ নির্বিচারে মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে অভিযান চালাচ্ছে, যেখানে নিরপরাধ মানুষও শিকার হচ্ছে।
মেওয়াত: ইতিহাস ও পরিচয়
ভারতের উত্তর-পশ্চিম অংশে অবস্থিত মেওয়াত অঞ্চল মূলত রাজস্থান, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের কিছু অংশজুড়ে বিস্তৃত। এখানকার প্রধান বাসিন্দারা মেও মুসলিম সম্প্রদায়, যারা শতাব্দীপ্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সংগ্রামের ইতিহাস ধারণ করে আছে।
ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, কৃষিনির্ভর জীবনধারা এবং ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক সহাবস্থানের জন্য মেওরা পরিচিত। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই অঞ্চলটি সাইবার অপরাধের কেন্দ্রস্থল হিসেবে আলোচিত হচ্ছে।
সরকারি সূত্রমতে, ভারতে নিবন্ধিত মোট সাইবার অপরাধের ৫৪% এই অঞ্চল থেকেই সংঘটিত হয়। বিশেষত মোবাইলভিত্তিক প্রতারণার (ফিশিং, ব্যাংকিং জালিয়াতি) অভিযোগ উঠেছে এখানকার যুবকদের বিরুদ্ধে।
কিন্তু এই অপরাধ কতটা সংগঠিত? সত্যিই কি পুরো অঞ্চল এতে জড়িত, নাকি কিছু গোষ্ঠীর অপরাধের দায় গোটা সম্প্রদায়ের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে?

পুলিশি অভিযানে শিশুর মৃত্যু: কী ঘটেছিল সেদিন?
২ মার্চ ভোরবেলা, রাজস্থানের আলওয়ার জেলার রঘুনাথগড় গ্রামে ইমরান খানের বাড়িতে হানা দেয় রাজস্থান পুলিশ। অভিযোগ, সাইবার অপরাধে জড়িত থাকার সন্দেহে তাকে গ্রেপ্তার করতে আসে পুলিশ বাহিনী।
ইমরানের স্ত্রী তখন ঘরের বাইরে একটি খাটে এক মাস বয়সী কন্যাসন্তানকে নিয়ে শুয়ে ছিলেন। ইমরানের দাবি, এক পুলিশ সদস্য তার স্ত্রীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন এবং তারপর আরেকজন পুলিশ সদস্য খাটের ওপর লাফিয়ে ওঠেন, যার ফলে নবজাতকটির মাথা থেঁতলে যায়।
“আমার মেয়েটা তখনো দুধ পান করছিল,” কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন ইমরান। “আমরা গরিব মানুষ, টাকা থাকলে কি এই অবস্থায় থাকতাম? ওরা বিনা কারণে আমাদের টার্গেট করছে।”
এই মর্মান্তিক ঘটনার পর গ্রামবাসীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তারা আলওয়ার পুলিশ সুপারের অফিস ঘেরাও করেন এবং অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের শাস্তির দাবি তোলেন।

মেওয়াতের মুসলিমদের প্রতি পুলিশি নিপীড়ন?
স্থানীয়দের অভিযোগ, রাজস্থান ও হরিয়ানার পুলিশ যৌথভাবে মেওয়াতে দফায় দফায় অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। তবে প্রকৃত অপরাধীদের ধরার বদলে পুলিশ নির্বিচারে নিরপরাধ গ্রামবাসীদের গ্রেপ্তার করছে এবং তাদের পরিবারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ দাবি করছে।
মেওয়াতের সাবেক সরপঞ্চ ও আইনজীবী লিয়াকত খান বলেন, “এটা কেবল অপরাধ দমনের অভিযান নয়, বরং মেওয়াতের মুসলিমদের টার্গেট করা হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “পুলিশ রাতের অন্ধকারে বাড়িতে ঢোকে, দরজা ভেঙে ফেলে, নারীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। গ্রেপ্তারের পর টাকা ছাড়া কাউকে ছাড়া হয় না। অথচ আসল অপরাধীরা ধরা পড়ে না।”
একটি বড় অভিযোগ হলো, পুলিশ এই অভিযানে কোনো মহিলা সদস্য সঙ্গে রাখে না, যা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনার পরিপন্থী।
স্থানীয় কংগ্রেস নেতা গাফুর খান বলেন, “মেওয়াতে সাইবার অপরাধের নামে অভিযান চালানো হলেও, প্রকৃত অপরাধীদের ধরা হচ্ছে না। টাকা দিলেই ছাড়া পাওয়া যায়, আর গরিবরা বছরের পর বছর জেলে পড়ে থাকে।”
সত্যিই কি মেওয়াতের যুবকেরা সাইবার অপরাধে যুক্ত?
মেওয়াতে সাইবার অপরাধের অস্তিত্ব যে রয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বিশেষত গোবিন্দগড়, পুনহানা, ফিরোজপুর ঝিরকা, নুহ, রেওয়ারি – এসব এলাকায় মোবাইল প্রতারণা চক্র সক্রিয় বলে পুলিশের দাবি।
গ্রাম প্রধান খুরশিদ খান বলেন, “সত্যি বলতে, মেওয়াতের প্রায় ৯০% পরিবার সাইবার অপরাধের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত। কিন্তু সেটা সবাই নয়। কিছু নির্দিষ্ট চক্র এই কাজ করে, আর নিরপরাধরা হয়রানির শিকার হয়।”
সাইবার অপরাধে জড়িতদের ধরার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য, তবে সঠিক তদন্ত ছাড়া পুরো মেওয়াত সম্প্রদায়কে দোষারোপ করাও অন্যায়।

নবজাতকের মৃত্যুর বিচার হবে? নাকি ধামাচাপা পড়বে?
ইমরান খানের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা দায়ের করা হলেও, এখন পর্যন্ত অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
নবজাতকের মৃত্যু পুলিশি বর্বরতার এক ভয়াবহ উদাহরণ হয়ে থাকলেও, এ ধরনের ঘটনাগুলো ভারতে প্রায়শই ধামাচাপা পড়ে যায়।
এখন দেখার বিষয়, প্রশাসন কি সত্যিই নিরপেক্ষ তদন্ত করবে, নাকি এটি আরেকটি “অজ্ঞাত পরিচয়ের পুলিশ সদস্যদের” বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার মতো হারিয়ে যাবে।
রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয় ও পুলিশের বক্তব্য পাওয়া না গেলেও, সাধারণ মানুষ মনে করেন—এটা কেবল এক শিশুর মৃত্যু নয়, বরং গোটা মেওয়াতের মুসলিমদের দমন করার একটি বড় চিত্রের অংশ।
সময় বলে দেবে, এই মৃত্যুর বিচার হবে, নাকি এও ইতিহাসের পাতায় আরেকটি অনুপ্রবেশ হয়ে থেকে যাবে।
প্রতিবেদনটি প্রথম প্রকাশ হয়েছে মাক্তুবমিডিয়া ডট কমে। মূল প্রতিবেদনটি এখানে ক্লিক করে পড়া যাবে।