মনে করো তুমি একটি স্বতস্ফূর্ত সামাজিক মূল্যবোধের অভাব বুঝতে পেরেছ। তোমার হাতে কিসের অভাব বুঝতে পেরেছ। তোমাকে কোথায় যেতে হবে কি করতে হবে জানতেও পেরেছ কিন্তু তোমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছে না কি করবে? তোমাকে নিয়ে ভাবার অনেক মানুষ আছে তুমি জানতে পারলে মানুষের রক্তের প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু নরখাদক মানুষ নিজেদের ইঙ্গিত দিয়েছে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তোমাকে এই ধারনার বাইরে রাখার । মূল্যবোধ সবার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। যখন বিবেকের মৃত্যু হয় তখন মূল্যবোধ বিলুপ্ত হয়ে যায় মানুষের মন থেকে।
অনুরোধের বিস্তৃতি রয়েছে যেখানে বৃষ্টির মত ঝরে পড়ে আকাশ থেকে। বসন্তের মত সৌন্দর্য উপভোগ করি ! আমাদের সিয়াম আমাদের কে পরিবর্তনের একটি মোক্ষম সুযোগ এনে দিয়েছে। সওয়াল মাসের চাঁদ দেখে সিয়াম ধরলাম তারপর জিলহজ মাসের চাঁদ দেখা অবধি বেঁধে রেখেছি তিরিশ রোজায় আমাদের ইচ্ছা, নিয়ত, আশা, ত্যাগ তিতিক্ষা গুলো।
আমরা এই সুবর্ণ সুযোগটাও পেয়ে যদি হাতছাড়া করে দি তাহলে কি হবে? তোমার জন্য দ্বিতীয় সুযোগ আসবে কি আসবে না একথা নিশ্চিত বলার উপায় নাই। কত মানুষকে দেখলাম গেল রমজানে এক সাথে বসে ইফতারি করতে, একসাথে একই কাতারে তারাবি পড়তে। তারাবি শেষে গল্প গুজব, কত দিনী আলোচনা করতে কিন্তু হায়! সেই মানুষ গুলো আজ এই রমজানে নেই! কেউ বাবার সমতুল্য, কেউ বা দাদুর। আবার কেউ ছিল আমার সমবয়সী।
অনেক ভাবতে ইচ্ছে করতে যে আমি কেন বেঁচে আছি রমজানে? আমার ঠাঁই তো কবরেও হতে পারত। কিন্তু না, মহান আল্লাহ তায়ালার আবার আমাকে সুযোগ দিল। আমার গুনাহ মোচন করার প্রয়োজন আছে। যেন পাপের নর্মদায় হাবুডুবু খাচ্ছি। আমার বাম কাঁধ ভারী হয়ে গেছে। মাথার নেমে আসছে গাঢ় জমকালো মেঘ। কি করব? নিজেকে আড়াল করতে পারিনা। কেমন যেন মনে হয় এটা আমার জীবনের অন্তিম পর্যায়। বয়সের ভারে ন্যুব্জ। কিন্তু বয়স তেমন কিছুই না।
তিন রমজান আগে আমাদের বাড়ির উঠোনের বা সাইডে একটি বাঁশঝাড় ছিল। বাঁশ ঝাড়ের পূর্বে এক বিরাট কর্দম পুকুর। পুকুরের ধারে ধারে আগাছা, ধুতুরা আর কলমি লতার জঙ্গল। জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে ছিল মাছরঙ্গা, বন মুরগি, আর সাপ বিচ্ছুদের আস্তানা। অবশ্য রাস্তায় উঠতেই এক মস্ত কদম গাছ। একবার প্যাচপ্যাচে বর্ষায় রমজান এলো। মহা খুশি। বালক বয়সে একটা খুবই আনন্দঘন মুহূর্ত। আমাদের সিয়াম পালনে কোনো বাধা ছিলোনা। খুশির জোয়ারে ভেসে ভেসে কি ভাবে কখন দিন কেটে যেত বোঝা জেতনা ।
এই রমজান আমাদের অনেক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে দিয়েছি। যারা আরবী কিছুই জানেনা নিরক্ষর তাদের অন্তত অক্ষর জ্ঞানের ধারনা তৈরি করে আগামী তিন মাসের টার্গেট পবিত্র কোরআন শিখিয়ে দেয়া, মানুষকে নামাজ মুখী করা, আল্লা ও রসূল সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান লাভ ইত্যাদি বিষয়ে নিরক্ষরতা কাটিয়ে অন্যদের কাছে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার ভূমিকা পালন করত এই রমজান মাস।
কুরআন চর্চায় অতিরিক্ত নিমগ্ন থাকা, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত সময় মত আদায়। মানুষকে উঁচু – নিচু বাচ্য না বলা। একে অন্যের সহযোগিতা। সবসময় মানুষের ভালো কিছু কামনা ইত্যাদি মহত্যই আমাদের শান্তি ও সংহতি গড়ে উঠতে সাহায্য করে। আর একটি ভালো বিষয় যেটা
এই মাসে মানুষের প্রচুর দান সদকা। অনেক গরিব মিসকিন দান করার চেষ্টা করে। তাদের ধারণা এই মাসে এক টাকা দান করলে ৭০ টাকার সমতুল্য সব পাওয়া যায়। যেহেতু মানুষ চাঁদা সারাদিন ক্ষুধা নিবারণ না করে ত্যাগ তিতিক্ষা সহ্য করে সিয়াম পালন করছে তাই দান সদকা করে অধিক সওয়াবের অধিকারী হতে চাই।
অনেক গরিব মুসলিম পরিবারের পাশাপাশি অমুসলিমদের প্রচুর অর্থ দিয়ে রমজানের বিশেষ সুবিধে গ্রহণ করে। কি সেই বিশেষ সুবিধে? প্রশ্ন জাগতে পারে। আল্লাহ পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারা 185 আয়াতে এরশাদ করেছেন —
রমযান মাস, এতে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। অতএব তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ মাস পাবে সে যেন তাতে রোযা পালন করে। আর যে অসুস্থ অথবা মুসাফির থাকে, তাকে অন্য দিনে এ সংখ্যা পূরণ করতে হবে। আল্লাহ তোমাদের (জন্য যা) সহজ (তা) করতে চান, তিনি তোমাদের কষ্ট চান না। যেন তোমরা (রোযার) নির্ধারিত সংখ্যা পূরণ করে নিতে পার এবং তোমাদেরকে যে সুপথ দেখিয়েছেন, তার জন্য তোমরা আল্লাহর তকবীর পাঠ (মহিমা বর্ণনা) কর এবং যেন তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পার।
আমাদের কষ্ট না দিয়ে অনেক সহজ করে দিয়েছেন রমজান। সুতরাং কেউ যেন তার দেয়া সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়। নিশ্চয় আমাদের জন্য আল্লাহ সুসংবাদ দিয়েছেন। সেইজন্য তো মুসলিমরা এই সুযোগ হাত ছাড়া করতে নারাজ। আমাদের কষ্ট গুলো ত্যাগ তিতিক্ষা এসবই আল্লাহর জন্য সপে দেয়া। এর নামই সিয়াম পালন। তবে অনেকে রোজা পালন বলে ভুল অর্থ করে। আসলে আরবী শব্দ সিয়াম যার অর্থ হলো বিরত থাকা। অনেকে মনে করে সারাদিন না খেয়ে থাকার নামই সিয়াম পালন। বিষয়টা কি মোটেও এমন হয়। পানাহার ছাড়াও যত ধরনের মন্দ কাজ, নিগ্রহ, দুশ্চরিত্র, অনিষ্টতা, কুরুচিকর মন্তব্বের মত যত ধরনের পাপ কাজ এসবই মহাসাগরে বিসর্জন দিয়ে দেয়ার নামই সিয়াম।
এই সিয়াম আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে আছে নানান স্মৃতি। তিন বছর আগেকার স্মৃতি বিজড়িত দিনগুলো এখন বড্ড নাড়া দিচ্ছে। যখন ভোরের সূর্য উঠত কুরআন তিলাওয়াত শুনতে শুনতে । সেহরীর আযানের আগে অবধি শোনা যেত সুমধুর কন্ঠে নবী রাসূলের শানে গজল ও গান। চারিদিকে অন্ধকার কিন্তু আকাশ বাতাসের যেন সিয়ামের পবিত্রতা বর্ণনা। মা ও বোনেদের তন্দ্রায় যেন পাখিরাও জেগে উঠলো। কাক ভোর। পাখিদের কুজনে মুখরিত। একটি শান্তিময়, আনন্দময় স্বর্গীয় অনুভুতি।
কিন্তু হায়, বড় দুঃখের বিষয় যে মানুষগুলো হাসি কান্নার সাত রঙের মিলেমিশে আমাদের মনোরঞ্জন করে রাখত আজ তারা কেউ বেঁচে। কিন্তু আমি বেঁচে থাকলেও নতুন কিছু প্রজন্মের কাছে এই অসহিষ্ণু উৎকণ্ঠায় কেঁপে উঠছে সমাজ। আদেশ–নিষেধ তাদের কাছে হাতের গুলি। কুরআন চর্চায় এত উদাসীনতা , ইফতারের পাঁচ আগে ওযু করতে বসা। এসব সিয়াম সাধনার আলো যেন ক্ষীণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভয় করছে? আল্লাহ পরিবর্তন করুক। পবিত্র রমজান মাস শেষ হলেও আমাদের সওয়াবের ভান্ডার যেন শেষ না হয়। আমাদের আগামীর দিনগুলি যেন রহমত, বরকত ও মাগফেরাতের ডালি দিয়ে সাঁজানো থাকে। আমাদের সিয়াম আপনি কবুল করুন।